বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন হামজা দেওয়ান চৌধুরী। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের তারকা, লেস্টার সিটির এই মিডফিল্ডার বাংলাদেশের জাতীয় দলে যোগ দিয়ে সারা দেশে সৃষ্টি করেছেন উন্মাদনা। তার গল্প শুধু একজন ফুটবলারের নয়, বরং স্বপ্ন, সংগ্রাম, এবং সাফল্যের এক অনুপ্রেরণাদায়ক যাত্রা।
Table of Contents
শৈশব থেকে শুরু: একটি স্বপ্নের পথচলা
১৯৯৭ সালের ১ অক্টোবর ইংল্যান্ডের লাফবরোতে জন্মগ্রহণ করেন হামজা। তার মা বাংলাদেশের হবিগঞ্জের এবং বাবা গ্রেনাডিয়ান বংশোদ্ভূত। এই মিশ্র সংস্কৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা হামজা খুব ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি আকৃষ্ট হন। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি লেস্টার সিটির যুব একাডেমিতে যোগ দেন। সেখান থেকেই শুরু হয় তার পেশাদার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নের পথচলা।
হামজার খেলার ধরন ছিল অনন্য। তার শক্তিশালী ট্যাকলিং, মাঠে অক্লান্ত পরিশ্রম, এবং খেলা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তাকে দ্রুতই আলাদা করে তুলেছিল। লেস্টারের যুব দলে তিনি ছিলেন একজন নেতা, যিনি তার দলকে একাধিক টুর্নামেন্টে জয় এনে দিয়েছেন।
প্রিমিয়ার লিগে উত্থান
২০১৭ সালে লেস্টার সিটির হয়ে লিগ কাপে লিভারপুলের বিপক্ষে অভিষেক হয় হামজার। এই ম্যাচে তিনি প্রমাণ করেন যে তিনি শুধু একজন প্রতিশ্রুতিশীল খেলোয়াড় নন, বরং বড় মঞ্চে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত। ২০২১ সালে লেস্টারের সঙ্গে এফএ কাপ জয়ের মাধ্যমে তিনি তার ক্যারিয়ারের একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক অর্জন করেন। এই জয় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই তরুণের জন্য ছিল গর্বের মুহূর্ত।
বর্তমানে তিনি লেস্টার সিটি থেকে ধারে শেফিল্ড ইউনাইটেডে খেলছেন। তার খেলার ধরন এবং মাঠে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা তাকে ইংলিশ ফুটবলে একটি পরিচিত নাম করে তুলেছে।
বাংলাদেশের ডাক: একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত
২০২৪ সালের শেষের দিকে হামজা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন এবং জাতীয় দলে খেলার সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ফুটবল ভক্তদের মাঝে উৎসাহের জোয়ার এনে দেয়। ২০২৫ সালের মার্চে তিনি সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পা রাখেন এবং শত শত সমর্থক তাকে স্বাগত জানান। “আসসালামু আলাইকুম, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ!”—এই কথাগুলো দিয়ে তিনি তার সমর্থকদের উদ্দেশে কথা বলেন, যা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়।
২০২৫ সালের ২৫ মার্চ ভারতের বিপক্ষে এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে হামজা বাংলাদেশের হয়ে অভিষেক করেন। যদিও ম্যাচটি ০-০ গোলে ড্র হয়, তার উপস্থিতি মাঠে নতুন শক্তি যোগ করে। কোচ হাভিয়ের কাবরেরা তার প্রশংসা করে বলেন, “হামজা আমাদের দলের জন্য একটি বড় সম্পদ।”
ব্যক্তিগত জীবন: শিকড়ের প্রতি ভালোবাসা
হামজা শুধু একজন ফুটবলার নন, তিনি তার শিকড়ের প্রতি গভীরভাবে সংযুক্ত। তিনি সিলেটি ভাষায় কথা বলতে পারেন এবং তার বাংলাদেশি সংস্কৃতির প্রতি গর্বিত। তিনি একজন সুন্নি মুসলিম এবং মাঠে নামার আগে কুরআনের আয়াত পড়েন, যা তাকে মানসিক শক্তি দেয়। তার পরিবার, বিশেষ করে তার মা এবং সৎ বাবা, তার ক্যারিয়ারে সবসময় পাশে ছিলেন। তিনি তার স্ত্রী এবং তিন সন্তানের সঙ্গে একটি সুখী জীবনযাপন করছেন।
বাংলাদেশের ফুটবলে হামজার প্রভাব
হামজার বাংলাদেশ দলে যোগদান শুধু একটি খেলোয়াড়ের আগমন নয়, এটি দেশের ফুটবলের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন। তার অভিজ্ঞতা এবং প্রিমিয়ার লিগের মান বাংলাদেশের তরুণ ফুটবলারদের জন্য অনুপ্রেরণা। তিনি প্রমাণ করেছেন যে কঠোর পরিশ্রম এবং নিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্বের সর্বোচ্চ মঞ্চে পৌঁছানো সম্ভব।
উপসংহার
হামজা দেওয়ান চৌধুরী বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার খেলার দক্ষতা, মাঠের বাইরে বিনয়ী আচরণ, এবং দেশের প্রতি ভালোবাসা তাকে সবার কাছে প্রিয় করে তুলেছে। ভারতের বিপক্ষে তার অভিষেক ম্যাচ হয়তো জয় এনে দেয়নি, কিন্তু এটি একটি নতুন যাত্রার শুরু। হামজার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ফুটবল নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে—এই আশা এখন প্রতিটি ফুটবলপ্রেমীর হৃদয়ে।
“ইনশাআল্লাহ, আমরা জিতব এবং এগিয়ে যাব,”—হামজার এই কথা বাংলাদেশের ফুটবলের ভবিষ্যৎকে আলোকিত করছে।