কিডনি টেস্ট নাম লিস্ট (kidney Test Name List)রোগ নির্ণয়ে যেসব পরীক্ষা করবেন!
একজন মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়েছে কিনা তা আমরা কিডনি টেস্টের মাধ্যমে জানতে পারি। কিন্তু এই কিডনি টেস্টের ব্যাপারে আমাদের অনেকরই অজানা। তাই আজকে আর্টিকেল জুড়ে থাকছে কিডনির টেস্ট নিয়ে নানা অজানা অনেক তথ্য।
তাহলে আসুন জেনে নিই কিডনি টেস্ট নাম লিস্ট।
কিডনি টেস্ট নাম লিস্ট – Kidney test name list
মানবদেহে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো কিডনি। কিডনি রক্তে থাকা দূষিত পদার্থগুলো পরিশোধন করে থাকে। এবং মূত্রের সাহায্যে সেগুলো আমাদের দেহ থেকে বের হয়ে যায়।
কিডনি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। এছাড়াও রক্তে লোহিত রক্তকণিকা তৈরি করতে সাহায্য করে। অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। একটি অসুস্থ বা অকার্যকর কিডনির কারণে মানুষ দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক জটিলতায় আক্রান্ত হয়। যা মানুষকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে।
প্রাথমিকভাবে কিডনি রোগের তেমন লক্ষণ বুঝা যায় না। ধীরে ধীরে কিডনির কার্যক্ষমতা কমতে শুরু করলে লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়।
কিডনি টেস্ট করাতে ডাক্তারগণ পরীক্ষার করাতে একটা কিডনি টেস্ট নাম লিস্ট দেন। এই টেস্টগুলো করালে রোগী কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়েছে কি না তা বুঝা যায়।
ন্যাশনাল কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্যানুযায়ী, দুইটি সাধারন টেস্ট করালেই ধরা পড়বে আপনার কিডনি ঠিকঠাক কাজ করছে কি না। টেস্ট ২টি হলোঃ
১. রক্ত পরীক্ষা বা জিএফআর
২. মূত্র পরীক্ষা বা এসিআর
১. রক্ত পরীক্ষা বা জিএফআর
এই পরীক্ষার মাধ্যমে আপনার রক্তে ইউরিয়া নাইট্রোজেনের পরিমাণ পরিমাপ করা হয়। এই প্রক্রিয়াটি জন্য আপনার BUN স্তরকে একটি স্বাভাবিক সীমার মধ্যে রাখতে হয়। যদি এই সীমা কমবেশি হয় তাহলে আপনি কিডনি রোগে আক্রান্ত হবেন।
ইউরিয়া নাইট্রোজেনের স্বাভাবিক মাত্রা আপনার বয়স এবং স্বাস্থ্যগত অবস্থার উপর নির্ভর করে। ইউরিয়া নাইট্রোজেনের স্বাভাবিক মাত্রা 7 থেকে 20 এর মধ্যে থাকে। যদি আপনার মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমবেশি হয়, তাহলে এটি কিডনি রোগের লক্ষণ। এই টেস্টের রিপোর্ট উপর নির্ভর করে আপনার কর্তব্যরত ডাক্তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করবেন।
২. মূত্র পরীক্ষা বা এসিআর
মূত্র পরীক্ষা বা এসিআর হলো অ্যালবুমিন ও ক্রিয়েটিনিনের অনুপাত। অ্যালবুমিন হলো এক ধরনের প্রোটিন। মূত্রে অ্যালবুমিন আছে কি না তা এসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে দেখা হয়। আমাদের শরীরের যেহেতু প্রোটিন রয়েছে সেক্ষেত্রে রক্তেও প্রোটিন থাকা স্বাভাবিক। তবে এই প্রোটিন কখনোই মূত্রে থাকার কথা নয়।
অনেকসময় প্রোটিনের জন্য কিডনি ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। তাই কিডনিতে রোগের লক্ষণ দেখা দিলে এসিআর পরীক্ষা করা হয় কিডনিতে প্রোটিন আছে নাকি দেখার জন্য। যদি পরীক্ষায় মূত্রে প্রোটিন পাওয়া যায়, তার মানে হলো কিডনিতে সমস্যা আছে।
বর্তমানে ডাক্তারগণ এই পদ্ধতির মাধ্যমে কিডনি টেস্ট পরীক্ষা করে থাকেন। এই টেস্টগুলোর মাধ্যমে জানা যায় কিডনিতে রোগ আছে কিনা। অনেকক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা বিবেচনা করে ডাক্তার আরো কিছু টেস্ট করিয়ে থাকেন। যেমনঃ-
১. রক্তচাপ
উচ্চ রক্তচাপ কিডনি রোগের একটি প্রধান কারণ। তাই আপনার কর্তব্যরত ডাক্তার আপনার রক্তচাপ নিরীক্ষণ করতে চাইবেন।
উচ্চ রক্তচাপ, ব্লাড সুগার, এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা অনিয়ন্ত্রিত থাকলে তা কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
২. ইমেজিং
ইমেজিং পরীক্ষা কিডনির ছবি পেতে ব্যবহার করা হয়। ইমেজিং পরীক্ষার মাধ্যমে ডাক্তার বুঝতে পারে আপনার কিডনিতে কতটা রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে বা রক্তনালীতে কোন বাধা বা সংকীর্ণতা আছে কিনা।
৩. কিডনি বায়োপসি
কিডনি বায়োপসি এমন একটি পদ্ধতি যেখানে কিডনির টিস্যুর একটি ছোট টুকরো অপসারণ করা হয়। এবং পরবর্তীতে কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে কতটুকু ক্ষতি হয়েছে এটা জানার জন্য একটি মাইক্রোস্কোপের নীচে পরীক্ষা করা হয়।
কিডনি রোগের উপসর্গ ও লক্ষণ
কিডনি টেস্ট নাম লিস্ট জানার পরে আমরা এই আর্টিকেলের এই অংশে জানবো কিডনি রোগের উপসর্গ ও লক্ষণের ব্যাপারে। প্রাথমিক অবস্থায় কিডনি রোগের তেমন কোনো লক্ষণ বুঝা যায় না। ধীরে ধীরে কিডনির কাজ করার ক্ষমতা কমতে শুরু করলে লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়।
কিডনি রোগের আক্রান্ত হলে অনেকগুলো উপসর্গ ও লক্ষণ দেখা দেয়। নিম্নে উল্লেখযোগ্য কিছু উপসর্গ ও লক্ষণ আলোচনা করা হলো
১. প্রস্রাবে পরিবর্তন
কিডনি রোগের প্রধাণ লক্ষণ প্রস্রাব পরিবর্তন। প্রস্রাব কম হওয়া কিংবা প্রস্রাব বেশি হওয়া দুটোই কিডনির রোগের লক্ষণ। কিডনি শরীর থেকে পানি বের করার পাশাপাশি পানি শুষে নেওয়ার কাজ করে থাকে। সেটি সঠিকভাবে করতে না পারলে প্রস্রাবের তারতম্য হয়ে থাকে।
এছাড়াও প্রস্রাবের রঙ পরিবর্তন প্রস্রাবে ফেনা ভাব হওয়া কিডনি রোগের লক্ষণ। কিডনিতে পাথর, ক্যান্সার ও টিউমারের হলে প্রস্রাবের সাথে রক্ত বের হতে পারে। ঘনঘন মলত্যাগ করা বা মলত্যাগের চাপ কিডনির রোগের লক্ষণ।
২. মাংসপেশিতে খিঁচুনি
কিডনির কর্মক্ষমতা নষ্ট হলে শরীরের ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা হয়৷ যারফলে মাংসপেশিতে খিঁচুনির মতো সমস্যা হয়। এছাড়াও কিডনিতে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের মাত্রা কমে গেলেও মাংসপেশিতে খিঁচুনি দেখা দেয়। এসকল সমস্যা দেখা দিলে বুঝে নিতে কিডনির সমস্যা হয়েছে এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে
৩. ত্বকের সমস্যা
কিডনি শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ ও অতিরিক্ত ক্ষতিকর তরল পদার্থ বের করে দেয়। এছাড়া কিডনি লাল রক্ত কণিকা তৈরি করে। খনিজ লবণের ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে। এরফলে ত্বকের সজীবতা বজায় থাকে।
কিডনিতে রোগ হলে কিডনি সেই কাজটি সঠিকভাবে করতে পারে না। যার প্রভাব এসে ত্বকের উপরে পড়ে। এতে ত্বকের সজীবতা বজায় থাকে না। ত্বক শুষ্ক খসখসে হয়। ত্বকে ঘা ও হাড়ের সমস্যা দেখা দেয়। যা কিডনির রোগের লক্ষণ।
৪. সব সময় ক্লান্তিভাব
কিডনির কর্মক্ষমতা মারাত্মক ভাবে কমে গেলে রক্তে অপদ্রব্য হিসেবে টক্সিন উৎপন্ন হয়। যারফলে আপনি দুর্বল ও ক্লান্ত অনুভব করেন। যার কারণে আপনি মনোযোগ সহকারে কোন কাজ করার সময় কাজে ব্যাঘাত ঘটবে।
৫. পা ফুলে যাওয়া
কিডনিতে রোগ আক্রান্ত হলে সোডিয়ামের ভারসাম্য নষ্ট হয়। যার কারণে পা ফুলে যায়। অনেক সময় খনিজ লবণের ভারসাম্যের কমে গেলেও এমন সমস্যা দেখা দিতে পারে
এছাড়াও কিডনি রোগে আক্রান্ত হলে বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, সব সময় ঠাণ্ডা অনুভব করা, জ্বর জ্বর ভাব, মাথা ঘোরা, কোমর ও পায়ে ব্যাথা হওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যদি উপরোক্ত উপসর্গ গুলো দেখা যায় তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
কিডনি রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা
আমাদের শুধু কিডনি টেস্ট নাম লিস্ট জানলে চলবে না। এর পাশাপাশি কিডনি সমস্যা হয়েছে বুঝতে পারলে কী কী ঘরোয়া চিকিৎসা নিতে পরি সেটার ব্যাপারেরও জানতে হবে৷ তাহলে আসুন জেনে নিই কয়েকটি ঘরোয়া উপায়
১. পানি
কিডনি রোগে আক্রান্ত হলে পর্যাপ্ত পানি খাওয়া উচিত। কারণ পানির মাধ্যমেই কিডনি থেকে টক্সিন সহ সংক্রামক সকল উপাদান বের হয়ে যায়। একজন সুস্থ মানুষের প্রতিদিন ২-৩ লিটার পানি খাওয়া উচিত।
২. আদা
কিডনিতে ইনফেকশন হলে ব্যথা করে। কিডনির ইনফেকশন দূর করতে আদা বেশ কার্যকর। আদায় থাকা জিনজেরোলস ব্যাকটেরিয়া কিডনি ইনফেকশন প্রতিরোধে বেশ কার্যকর। তাই প্রতিদিন আদা চা পান করতে পারেন অথবা কয়েক টুকরো আদা চিবিয়ে খেতে পারেন। এতে ইনফেকশন এবং কিডনির সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে।
তবে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস বা গলব্লাডার স্টোনের রোগীদের আদা খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। এবং সাধারণ লোকের জন্য দিনে ৪ গ্রামের বেশি আদা খাওয়া উচিত নয়। যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
৩. হলুদ
মশলা হিসেবে হলুদ খুব উপকারী। হলুদে আছে কারকিউমিনে অ্যান্টি ফাঙ্গাল উপাদান করে। যা মাইক্রোব তৈরিতে বাধা দেয়। এরফলে কিডনিতে সৃষ্টি হওয়া বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান তৈরি হতে পারে না। তাই আমাদের প্রতিদিনের রান্নায় হলুদ ব্যবহার করা উচিত।
এতে কিডনি সমস্যা দূর হয়। তবে পরিমাণমতো হলুদ খেতে হবে। বেশি পরিমাণে হলুদ খেলে এতে উল্টো কিডনিতে পাথর তৈরি করে।
৪. বেকিং সোডা
কিডনির বাইকার্বোনেট মাত্রা বাড়িয়ে দেয় বেকিং সোডা। যারকারণে কিডনির কার্যকারিতা বেড়ে যায় কয়েকগুন। বেকিং সোডা কিডনি থেকে ক্ষতিকর উপাদান বের করতে সাহায্য করে।
এজন্য কিডনিতে সমস্যা হলে দিনে একবার এক গ্লাস পানির সঙ্গে আধা চামচ বেকিং সোডা মিশিয়ে পান করতে পারেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে বেকিং সোডা বেশি গ্রহণ করলে কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে।
৫. অ্যালোভেরা
কিডনির রোগ নিরাময়ে অ্যালোভেরা ভালো কার্যকর। শরীর থেকে ক্ষতিকর টক্সিন বের করে দেয় অ্যালোভেরা। কিডনি রোগে আক্রান্ত হলে দিনে একবার অ্যালোভেরা জুস পান করতে পারেন। এছাড়াও অ্যালোভেরার নির্যাস, লেবুর রস দুই গ্লাস পানির সঙ্গে মিশিয়ে মিক্সারে মিক্স করে পান করতে পারেন।
৬. পর্যাপ্ত বিশ্রাম
কিডনি সমস্যা হলে বিশ্রাম অনেক উপকারি। বিশেষ করে কিডনি পাথর বা ইনজুরি হলে অতিরিক্ত হাঁটাচলা, কাজকর্ম এবং বেশি এক্সারসাইজ করলে ব্লিডিং বাড়তে পারে। তাই পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়াই উত্তম। যেইভাবে শুয়ে থাকলে কিডনি ব্যথা কম হয় , সেইভাবে শুয়ে থাকতে হবে।
উপসংহার
পৃথিবীতে যত প্রাণঘাতী রোগ রয়েছে এর মধ্যে কিডনি রোগ একটি। যা মানবদেহের নীরবে ক্ষতি সাধন করে। তাই লক্ষণ দেখা দেওয়া মাত্রই আমাদের ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
কিডনি টেস্ট নাম লিষ্ট এর উপর ভিত্তি করে ডাক্তারেরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।
Tag: কিডনি টেস্ট নাম লিস্ট, কিডনি ফাংশন টেস্ট, KFT টেস্টের নাম, কিডনি সুস্থ রাখার পরীক্ষা, ক্রিয়েটিনিন টেস্ট, eGFR, BUN টেস্ট, ইউরিন রুটিন টেস্ট, প্রস্রাবের অ্যালবুমিন, সিরাম ক্রিয়েটিনিন, গ্লোমেরুলার পরিস্রাবণ হার, রক্তের ইউরিয়া নাইট্রোজেন, Urine ACR, Albumin to Creatinine Ratio, কিডনি রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা, কিডনি আল্ট্রাসনোগ্রাফি, নেফ্রোলজি পরীক্ষা, কিডনির কার্যকারিতা পরীক্ষা, কিডনি ফাংশন টেস্টের খরচ, কিডনি টেস্টের স্বাভাবিক মাত্রা, কিডনি ড্যামেজ বোঝার উপায়
